
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের জমে উঠছে আলোচনার তাপ। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একদিকে বিএনপি তাদের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে তৎপর, অন্যদিকে ইসলামপন্থী দলগুলো নিজেদেরকে বিকল্প শক্তি হিসেবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একধরনের সমঝোতা প্রচেষ্টায় নেমেছে। তবে এই সমঝোতাকে এখনই 'জোট' বলতে রাজি নয় সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপির সঙ্গে ভোটের প্রতিযোগিতায় ‘অন্য প্ল্যাটফর্ম’ দাঁড় করাতে জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিসসহ কওমি ঘরানার একাধিক দল একত্রিত হওয়ার প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের দাবি—দেশের মানুষ বিকল্প নেতৃত্ব চায়। আর সে বিকল্প হতে হলে সর্বোচ্চ কৌশল নিতে হবে।
ইতিমধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে পাঁচটি ইসলামি নিবন্ধিত দল একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করেছে। এপ্রিল মাসে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে ‘বোঝাপড়া’র ঘোষণা দেয়। এতে জামায়াতও পরবর্তীতে আলোচনায় জড়ায়। এমনকি বরিশালে চরমোনাই পীরের সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠক হয়েছে বলেও জানা গেছে। এতে স্পষ্ট যে, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ভেতরে ভেতরে বিএনপির বাইরে গিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার প্রবল চেষ্টা চলছে।
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, “আমরা কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নই। মানুষ সামনে বিকল্প শক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। সেজন্য একটি সম্মিলিত জোটের চিন্তা করা হচ্ছে। আমাদের ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ কৌশল নিতে হবে।”
অপরদিকে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সম্প্রতি বলেন, “নীতিগতভাবে একটা থিংকিং আছে। সমঝোতার চেষ্টা চলছে। এখনো এটা নির্বাচনী জোট নয়, পারস্পরিক আলোচনা চলছে।” তিনি আরও বলেন, এই জোট তাদের জন্য যারা ফ্যাসিবাদ চায় না, কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে চায় এবং জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানকে ধারণ করে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক এই সমঝোতা আন্দোলনের বাইরেও রয়েছে সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে অভিন্ন ভাবনা। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিসের দুটি অংশ সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা কমিয়ে নিয়োগ কমিটি গঠনের পক্ষে। অনেক দলই নিচু কক্ষেও আনুপাতিক পদ্ধতি চায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি বদলানো এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগেই চায় জামায়াত ও এনসিপি।
এই প্রস্তাবগুলোর বেশ কিছুতে বিএনপির স্পষ্ট দ্বিমত রয়েছে। বিএনপি মনে করে, সরকারপ্রধানের ক্ষমতা খর্ব করলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সমস্যা হবে। পাশাপাশি তারা উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে সরাসরি ভোটের পরিবর্তে নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে বণ্টন চায়। এসব মতপার্থক্য ইসলামপন্থী ও বিএনপির মাঝে সাংগঠনিক দূরত্ব সৃষ্টি করছে, বলছেন বিশ্লেষকরা।
যদিও এসব দল একে এখনো আনুষ্ঠানিক জোট বলে ঘোষণা দেয়নি, কিন্তু মাঠপর্যায়ে তাদের একসাথে কাজ করার আলামত স্পষ্ট। ১ জুলাই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল অংশ নিলেও বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অন্যদিকে একই দিনে বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে জামায়াত অংশ নেয়, ইসলামী আন্দোলন নয়। এই ‘দুই মঞ্চ’ প্রমাণ করে, তারা পৃথকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বর্তমানে রাজনৈতিক মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি এবং জনবিচ্ছিন্নতার কারণে বিএনপিকে অনেকেই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখছেন। তবে ছোট দলগুলোর মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। সে আশঙ্কা থেকে স্বাধীন অবস্থানে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায় ইসলামপন্থী দলগুলো।
এই অবস্থান থেকেই তারা বলছে, বিএনপি ‘নির্বাচনের জন্য পাগল’—এমন অভিযোগ অযৌক্তিক। বরং তারা দাবি করছে, বিএনপির অবস্থান ও তাদের প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে এত ফারাক যে, ইসলামি ও মধ্যপন্থী শক্তিগুলোর জন্য বিকল্প পথ খোলা রাখা ছাড়া উপায় নেই।
এখন দেখার বিষয়, এই ‘সমঝোতা’ অবশেষে নির্বাচনী মাঠে কতটা রূপ পায়, এবং সেটা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে কি না।
শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ০৪ জুলাই ২০২৫
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের জমে উঠছে আলোচনার তাপ। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একদিকে বিএনপি তাদের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে তৎপর, অন্যদিকে ইসলামপন্থী দলগুলো নিজেদেরকে বিকল্প শক্তি হিসেবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একধরনের সমঝোতা প্রচেষ্টায় নেমেছে। তবে এই সমঝোতাকে এখনই 'জোট' বলতে রাজি নয় সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপির সঙ্গে ভোটের প্রতিযোগিতায় ‘অন্য প্ল্যাটফর্ম’ দাঁড় করাতে জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিসসহ কওমি ঘরানার একাধিক দল একত্রিত হওয়ার প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের দাবি—দেশের মানুষ বিকল্প নেতৃত্ব চায়। আর সে বিকল্প হতে হলে সর্বোচ্চ কৌশল নিতে হবে।
ইতিমধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে পাঁচটি ইসলামি নিবন্ধিত দল একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করেছে। এপ্রিল মাসে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে ‘বোঝাপড়া’র ঘোষণা দেয়। এতে জামায়াতও পরবর্তীতে আলোচনায় জড়ায়। এমনকি বরিশালে চরমোনাই পীরের সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠক হয়েছে বলেও জানা গেছে। এতে স্পষ্ট যে, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ভেতরে ভেতরে বিএনপির বাইরে গিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার প্রবল চেষ্টা চলছে।
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, “আমরা কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নই। মানুষ সামনে বিকল্প শক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। সেজন্য একটি সম্মিলিত জোটের চিন্তা করা হচ্ছে। আমাদের ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ কৌশল নিতে হবে।”
অপরদিকে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সম্প্রতি বলেন, “নীতিগতভাবে একটা থিংকিং আছে। সমঝোতার চেষ্টা চলছে। এখনো এটা নির্বাচনী জোট নয়, পারস্পরিক আলোচনা চলছে।” তিনি আরও বলেন, এই জোট তাদের জন্য যারা ফ্যাসিবাদ চায় না, কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে চায় এবং জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানকে ধারণ করে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক এই সমঝোতা আন্দোলনের বাইরেও রয়েছে সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে অভিন্ন ভাবনা। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিসের দুটি অংশ সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা কমিয়ে নিয়োগ কমিটি গঠনের পক্ষে। অনেক দলই নিচু কক্ষেও আনুপাতিক পদ্ধতি চায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি বদলানো এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগেই চায় জামায়াত ও এনসিপি।
এই প্রস্তাবগুলোর বেশ কিছুতে বিএনপির স্পষ্ট দ্বিমত রয়েছে। বিএনপি মনে করে, সরকারপ্রধানের ক্ষমতা খর্ব করলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সমস্যা হবে। পাশাপাশি তারা উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে সরাসরি ভোটের পরিবর্তে নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে বণ্টন চায়। এসব মতপার্থক্য ইসলামপন্থী ও বিএনপির মাঝে সাংগঠনিক দূরত্ব সৃষ্টি করছে, বলছেন বিশ্লেষকরা।
যদিও এসব দল একে এখনো আনুষ্ঠানিক জোট বলে ঘোষণা দেয়নি, কিন্তু মাঠপর্যায়ে তাদের একসাথে কাজ করার আলামত স্পষ্ট। ১ জুলাই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল অংশ নিলেও বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অন্যদিকে একই দিনে বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে জামায়াত অংশ নেয়, ইসলামী আন্দোলন নয়। এই ‘দুই মঞ্চ’ প্রমাণ করে, তারা পৃথকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বর্তমানে রাজনৈতিক মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি এবং জনবিচ্ছিন্নতার কারণে বিএনপিকে অনেকেই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখছেন। তবে ছোট দলগুলোর মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। সে আশঙ্কা থেকে স্বাধীন অবস্থানে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায় ইসলামপন্থী দলগুলো।
এই অবস্থান থেকেই তারা বলছে, বিএনপি ‘নির্বাচনের জন্য পাগল’—এমন অভিযোগ অযৌক্তিক। বরং তারা দাবি করছে, বিএনপির অবস্থান ও তাদের প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে এত ফারাক যে, ইসলামি ও মধ্যপন্থী শক্তিগুলোর জন্য বিকল্প পথ খোলা রাখা ছাড়া উপায় নেই।
এখন দেখার বিষয়, এই ‘সমঝোতা’ অবশেষে নির্বাচনী মাঠে কতটা রূপ পায়, এবং সেটা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে কি না।
আপনার মতামত লিখুন